অনেক দিন পরে একটা বাংলা গল্প লিখেছি - এক ঘেয়ে কাজ করে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম - তাই নিশ্রামের জন্যে- কেমন লাগল জানাবে।
গল্পটার প্রথম অংশ যখন Facebook এ দি, সুজয়াদি তার মেয়ে পাখিকে সেটা পড়ে শোনায়। তখন তার কত প্রশ্ন- 'ভূতের এত হাঁচি হয় কেন ? ভূতের মা ওকে ওষূধ দেয় নি কেন? ' আমি তো লিখে খালাস। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে এটা গুরু দায়িত্ব। মা মেয়ের সম্পর্ক যেন চিরদিন এমনি থাকে, আর পাখির অনুসন্ধিৎসা যেন কখনো কম না হয় সেই প্রার্থনা করি...
ভুতের খুব মন খারাপ। তার হাঁচি হয়েছে শুক্রবার থেকে, এখনো যায় নি। অথচ হাঁচি নিয়ে সে ঠিক গিন্নির জন্যে পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতে পারছে না। মাছের কাছে গিয়ে হাঁচি দিলেই সব পো-পো করে পালাচ্ছে। আর এ তো মানুষের হাঁচি না, এ হলো ভুতের হাঁচি - এক সঙ্গে ৩০- ৪০ টা তো হবেই। তাই সে নাজেহাল। খুব মন খারাপ করে বুড়ো বটগাছের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে, আর ভাবছে যে কি করা যায়।
তখন রাত ১০ টা হবে, অপু মাস্টারমশাই এর বাড়ি থেকে অঙ্ক করে ফিরছিল। খুব কঠিন একটা অঙ্ক তার মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই তার সমাধান মিলছে না, কিন্তু মাস্টারবাবুর খুব বিশ্বাস- কেউ যদি পারে তবে অপুই পারবে। তাই সে খুব চিন্তিত। সবাই জানে অঙ্ক স্যার খুব কড়া , কিন্তু অপু কে খুব ভালবাসেন। অপু বাধ্য ছেলে। রোজকার পড়া করে, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ভূগোল আর অঙ্ক তার খুব প্রিয় বিষয়। সে দিন রাত এটলাস ঘাটাঘাটি করে আর অঙ্ক কষে যায়। বাংলায় কম নম্বর পায় বলে মার খুব মন খারাপ। উনি বলেন- 'বাঙালির ছেলে ভালো বাংলা লিখতে না পারলে কেমন লাগে?' বাবা বলেন: 'আহা! ওর যা ভালো লাগে পড়তে দাও না! বড় হলে যখন ভাষাটা বুঝতে শিখবে তখন নিজে থেকেই বাংলা সাহিত্য পড়বে। '
অপুর দিদি কিন্তু ইয়া মস্ত-মস্ত গল্পের বই, উপন্যাস পড়ে শেষ করে দেয়। ছুটির দিনে কখনো উপুর হয়ে, কখনো জানালার কার্নিসে বসে, চশমা চোখে দিদি সকাল থেকে সন্ধ্যে খালি গল্পের বই পড়ে। মা তখন ডেকে ডেকে হয়রান। 'চান করতে যাও, খেতে এসো , এবার বই রেখে একটু ঘুমও , চোখটা আরো যাবে- এবার একটু বিশ্রাম দে,' ইত্যাদি ....
অপু ফিকফিক করে হাঁসে। তখন দিদির পায়ে আরশোলা ছেড়ে দিলেও দিদি বুঝতে পারবে না। যেন ধ্যান করছে! অপু মজা করে বলে - 'দেখিস বাল্মীকির মত উইঢিপি হয়ে যাস না যেন!' তাই শুনে দিদি শুধু বলে- হু!
***
এমন করেই অপুর দিন কাটছিল। সেই দিন রাতের কথায় ফিরি। অপু সাইকেল চালাতে পারে তাই আর ছোটবেলার মত বাবাকে নিতে আসতে হয় না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সে দিব্যি কলেজ টিলা- যেখানে স্যারের বাড়ি সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসে। স্যারের বাড়িটা একটা পুকুরের ধারে। স্যারকে বলতে শুনেছে যে সেই পুকুরের নাকি এক কালে খুব মাছ ছিল- কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মাছের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। আগে বিকেলে দাড়িয়ে অনেক রকম মাছের খেলা দেখা যেত। এখন কচুরিপানায় সব ঢেকে গেছে। মাছ হয়ত কিছু আছে , তবে পানার জন্যে কিছু দেখা যায় না। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অপু পড়েছিল : পানার দরুন জলের তলায় সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সালোকসংশ্লেষ বা photosynthesis হ্রাস পায় , আর তার জন্যে অন্যান্য উদ্ভিদ আর জলজ জীবন বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু অপু জানে তার দিদির সেই ফুল খুব পছন্দ। একদিন অপু মনে করে দিদির জন্যে নিয়ে যাবে।
কলেজ টিলা নাম কেন বলি। ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরার রাজা মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য একটি কলেজের স্থাপনা করেন। তাঁর নামেই কলেজ হয়, সংক্ষিপ্তে এম. বি.বি কলেজ।কলেজের একপাশে কলেজে কর্মরত অধ্যাপক ও অন্যান্য কর্মচারিদের জন্যে কিছু বাসভবনের নির্মান করা হয়। কলেজ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা একটি টিলার ওপর অধিষ্ঠিত হওয়ায় অঞ্চলটার নাম পরে কলেজ টিলা। টিলার নিচে একটা ক্লাব আছে - মডার্ন ক্লাব। সেখানে দূর্গা পুজো হয়। পুকুরের ওপর মাচা লাগিয়ে ঠাকুর রাখা হয়। আবার সেই পুকুরের জলেই বিসর্জন।
স্যারের বাড়ি থেকে সাইকেল করে আসতে কলেজ পেরিয়ে একটা শুনশান রাস্তা। দিনের বেলায় কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সেখানে ভিড় থাকে । সাইকেল, রিক্সা, গাড়ি; চানাচুর, চা, ফুচকার ষ্টল; ফেরিওয়ালা, অটোওয়ালা - সব মিলে বেশ রমরমা। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই সব চুপচাপ। রাত ৮ টায় মনে হয় বুঝি মধ্যরাত। নৈশ বিদ্যালয়ে কিছু বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষা হয় হয়ত- কিন্তু তাদের কোন সাড়া শব্দ নেই।
অপু তখনো অঙ্ক নিয়ে ভেবে যাচ্ছিল । সাইকেল চালাবার কথা তার মনেই নেই। কিছু দূর এসে খেয়াল হল যে সাইকেলের টায়ার টা puncture হয়ে গেছে।কি আর করা যাবে, অগত্যা পায়ে হেঁটেই সে টিলা থেকে নামার উদ্যোগ করল। ক্লাবের কাছে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান আছে, কিন্তু সেটা হয়ত এত রাতে খোলা থাকবে না। ক্লাবে অনেক সময় তার বন্ধু হাবুল কেরাম খেলে। তার কাছে সাইকেলটা রেখে না হয় একটা রিক্সা করে বাড়ি ফেরা যাবে। ক্লাব ঘরের সামনে এক আধটা রিক্সা হয়ত এখনো পাওয়া যাবে- এ সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অপু চলছিল।হঠাৎ ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাঁচি শুনতে পেল। প্রথমে হাঁচি মনে হলেও, সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিল না। এক সঙ্গে এত কেউ হাঁচতে পারে নাকি?
সে আবছা চাঁদের আলোয় দেখল কে যেন বুড়ো বটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পাগল টাগল না তো? লোকটা পরে গিয়ে আছাড় খেলে আর রক্ষা নেই। টিলা গড়িয়ে সোজা পুকুরের জলে- ঝপাৎ। অপু একটু জোর গলায় বলল: কে? কে ওখানে?
আরেকটা হাঁচি।
আচ্ছা আহাম্মক তো - জবাব ও দেয় না।
অপু আবার বলল- এত রাতে গাছে চড়েছেন কেন- পরে গেলে ব্যাথা পাবেন।
উত্তর এলো- হুজুর মাপ করবেন, শরীরটা ভালো নেই, তাই একটু জিরচ্ছিলাম।
অপু: ও, তো শরীর খারাপ যখন বাড়ি গেলেই পারেন। রাত বিরেতে গাছে চড়ার শখ কেন হল ?
-আজ্ঞে , বাড়ি গেলে বউ বড় ধাতানি দেবে- আজ ও মাছ পেলাম না।
- মাছ পান নি তো কি হয়েছে, আজ নিরামিষ খেয়ে নেবেন
-নিরামিষটা ঠিক পোষে না। কচি পাঁঠার ঝোল হলে একটু কব্জি ডুবিয়ে খেতাম গরম গরম ভাত দিয়ে- সঙ্গে একটা গন্ধরাজ লেবু।প্রথম পাতে যদি একটা ইলিশ মাছ ভাজা আর সোনা মুগের ডাল পরে তাহলে আহা- আত্মাটা খুব তৃপ্তি পেত। কিন্তু বলি কি- গরীবের কপালে কি এসব জোটে? এখন পান্তা ভাতে একটু ঘি পরলেই গন্ধে গন্ধে খেয়ে নি।
অপু ভাবলো- এ খেয়েছে- এ তো খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল- আরও দেরী হয়ে যাবে যে !
লোকটা মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেই বলল- তা বাপু এত রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
অপু ভাবলো- কি বলবে? অনেক ভেবে সত্যি কথাটাই বলল - সাইকেলটার পান্চার হয়েছে , তাই হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
-ও। সে তো অনেক পথ। কেষ্ট-এর দোকান ও তো বন্ধ হয়ে গেছে হবে। দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। বলে লোকটা এক লাঁফে গাছ থেকে নেমে পড়ল।
লোকটা দেখতে বড্ড রোগা ভোগা - সত্যি মনে হচ্ছে অসুস্থ। পরনে খাটো করা ধুতি আর ময়লা চাদর। গায়ের রং মিশমিশে কালো। চেহারাটা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না তবে দাঁত গুলো ধবধবে সাদা। এ তো দিব্যি টুথপেষ্ট বা চুয়িং গামের বিজ্ঞাপন করতে পারে।
অপু বলল- আপনি পারবেন ঠিক করতে?
লোকটা মুচকি হেসে বলল- তা আমি পারব।
লোকটার কিন্তু ততক্ষণে হাঁচি কমে গেছে।
সে সটান মাটিতে শুয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করল। এরপর বলল,
- এ দেখুন, কি বলেছিলাম?
অপুর তো মুখ হাঁ ! এ কি করে সম্ভভ? ভুল দেখছি না তো? ওর হাতে কি কোনো ছোট পাম্প ছিল? চাদরের তলায়? না। হলে সে দেখতে পেত।
মুখে তারিফ করে বলল- বাঃ ! এমন তো কখনো দেখিনি। তোমার তো এলেম আছে দেখছি !
লোকটা আবার হে হে করে একটু হাসলো, ঘাড়টা একটু কাৎ করে বলল : অভয় দেন তো একটা কথা বলি?
অপু: কি?
- আজ্ঞে আগে কথা দিন রাগ করবেন না, বা হুট করে পালিয়ে যাবেন না?
-পালাব কেন?
- না, মানে বলা যায় না তো - অনেক দিন পরে একটা মানুষ পেয়েছি যে আমাকে দেখতে পেয়েছে- তাই খুব আল্লাদ হচ্ছে। পাছে কোনো বেআদবি করে বসি।
- এসব কেন বলছেন- আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।
- তবে একটা কথা বলি শুনুন - আমি ভূত
- ভূত মানে? ভূতনাথ ?
- না, মানে আমি ভূত
- মরে গিয়ে যে হয়?
-ছি ছি ! এসব কথা কইছেন কেন? আমাকে কি মৃত মনে হচ্ছে ?
-তাহলে?
-না মানে, আপনাদের ইস্কুলে পড়ায় না -তরঙ্গদৈর্ঘ্য?
-wavelength?
-ধরুন আমি অন্য কোনো wavelength এ থাকি।কিন্তু সাধারণ মানুষ আমাকে দেখতে পায় না কেন না তাদের মস্তিষ্ক সজাগ নয়। অন্য সময় আপনি হেঁটে গেলে আপনিও হয়ত আমাকে দেখতে পেতেন না। কিন্তু আপনার স্নায়ু হয়ত কোনো কারণে উত্তেজিত বা অতিসক্রিয়।
-হ্যাঁ, আমি একটা অঙ্ক নিয়ে ভাবছিলাম বটে।
অপু সাহসী ছেলে। ভুতের ভয় তার নেই। ভূত কেন, ব্রহ্মদত্যির ভয় ও নেই।
তাই সে জিজ্ঞাস করলো -তাহলে কি আমি তোমাকে কাল বা পরশু দেখতে পারব না?
-একটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
-কিরকম?
-আপনি কোন নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত সময়ে আবার এখানে আসবেন - যদি দেখা হয় তাহলে এটার একটা নিস্পত্তি হবে। আমারও কথা বলার লোক জুটবে।
অপু বলল- বেশ তো !
পরের শুক্রবার তাকে স্যারের বাড়ি আবার আসতে হবে, ফেরার পথে না হয় লোকটার সঙ্গে দেখা করে যাব।
সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে তাড়াতাড়ি প্যাডেলে পা ফেলল ।
***
অপুর আসতে দেরী দেখে মা একটু চিন্তিত ছিলেন, ভাবছিলেন একবার স্যারের বাড়িতে ফোন করবেন কিনা। অঙ্ক স্যার অনেক সময় বাকিদের পড়া হয়ে গেলেও অপুকে নিয়ে বসে থাকেন। মাসের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে কত বার শুনতে হয়েছে: 'দিদি এসব কেন করেন? অপুকে আমি ছাত্র হিসেবে পেয়েছি- এটাই আমার সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি। টাকা পয়সা দিয়ে গোল বাঁধান কেন?' অপুর মা তাও স্যারের হাতে খামটা গুজে দিয়ে আসেন। উনি নিজে শিক্ষিকা, স্যারের মনভাব ভালই বোঝেন কিন্তু অপুর জন্যে উনিও খুব খাটেন।তাঁর জন্যে কিছু করাটা তো কর্তব্য।
ঠিক সেই সময়ই সদর দরজা দিয়ে অপু ঢুকলো। মা বললেন: কি রে, আজ এত দেরী? হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খাবি আয়।
মায়েরা যেমন হয় - মাথায় যত চিন্তাই থাকুক- খাবারটা আগে খাইয়ে নেয়।
***
শুক্রবার যেন আসেই না, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মনটা চলে যাচ্ছিল বটগাছের সেই লোকটার কাছে। সে কি সত্যিই তাকে দেখেছিল? দিনের আলোতে সেই মোলাকাত কেমন মনগড়া মনে হচ্ছিল- হয়ত চলতে চলতেই সে কিছুক্ষনের জন্যে ঘুমিয়ে পরেছিল আর সাময়িক অর্ধচেতনায় সেই চরিত্রের উৎপত্তি। আবার না গেলে বোঝা যাচ্ছে না।
পরিকল্পনা মাফিক সে শুক্রবার পড়ার শেষে বটগাছের তলায় দাড়ালো। লোকটা যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে আরেকটু বেশি রুগ্ন মনে হল । এবার অপুর একটু চিন্তা হলো- লোকটা অসুস্থ। ডাক্তার দেখেয়িছে কিনা কে জানে? একবার ভাবলো মানিব্যাগে যা আছে ওকে দিয়ে বিদায় করবে আর ওষুধ-পথ্যির আয়োজন করতে বলবে।
লোকটা যেন আন্দাজ করেই আচমকা বলে উঠলো - মানুষের টাকা আমার কোনো প্রয়োজনে আসে না, আমি তোমার কাছে অন্য সাহায্য চাই।
-কি বলুন? (আজ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। কাল তুই বলবে না তো?)
-তুমি তো শিবসাগর দেখেছ - কখনো ভেবেছ যে কত প্রাণ তার ওপর নির্ভরশীল?
-ওই পানাপুকুরের নাম বলছেন? তার নাম শিবসাগর জানতাম না তো !
-হ্যাঁ, সব পুকুরের একটা নাম আছে, চরিত্র আছে । সব জলাসয় তো আর প্রাকৃতিক না, কিছু মনুষ্যনির্মিতও আছে - যেটা ঘটা করে নির্মান হয় , কিছু দিন তার উপযোগিতার মূল্যও থাকে, এরপর মানুষ ভুলে যায়, উপেক্ষা করে। কিন্তু সেই জলাশয়ে যে প্রাণের সঞ্চার হয় তার দায়িত্ব কার? সেই মাথাব্যাথা কেউ নেয় না কেন? অদূরদর্শিতায় যে মানুষ নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে সে কথা কজন জেনেও স্বীকার করবে? স্বীকার করলেই তো দায় বাড়বে!
লোকটা আরও বলল-আমি হাকিম দেখাতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন যে আমার এলার্জি আছে - চারিদিকে প্রাণীদের যে হাহাকার হচ্ছে সেই সব আমার তন্ত্রে অতিপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তার ফলে অনবরত হাঁচি হচ্ছে। মানুষের সে সব চিৎকার কানে আসে না বলে তারা অগ্রাহ্য করতে পারে, আমি পারি না অথচ আমার করার ক্ষমতাও খুব সীমিত - মানুষ না চাইলে আমি মন্দ ও করতে পারি না, ভালো ও করতে পারি না।
অপু আরেকবার লোকটাকে দেখল- কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে- ধুলো মাখা শরীর। চোখগুলো বড় বড়, উদাস দৃষ্টি । কাকে যেন এমন দেখেছে। এ জন্যেই তো এতক্ষণ দাড়িয়ে সে পাগলের প্রলাপ শুনছিল। এতক্ষণে সে বলল- কিন্তু আমি কি করতে পারি?
লোকটা বলল- তুমিই পারবে। আমি জানি। তোমার প্রাণশক্তি অনেক। সেই শক্তির সদ্ ব্যাবহার কর- অন্যের উপকার কর- নিজেও উপকৃত হবে।
লোকটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলল। শুনে অপু কিছুটা খুশি হলো- কেউ তাকে এত ভরসা করছে শুনে তার মনের জোরটা বেশ তেজ হলো। পাগলই হোক না কেন। সে অনেক বার নিজেও ভেবেছে পুকুরটার জন্যে কিছু করা উচিত। সে একা পারবে না - বন্ধুদের সাহায্য চাই। স্কুলের নোটিশ বোর্ডে একটা বিজ্ঞপ্তি দেবে ভাবছে -স্বেচ্ছাসেবক চাই। Socially Useful Productive Work (SUPW) ক্লাসের স্যারকেও বলতে হবে আর অঙ্ক স্যারকেও। পরীক্ষা শেষ হলেই গ্রীষ্মের ছুটি- তখন ছেলে মেয়েরা একটা প্রজেক্ট পেলে উৎসাহী বোধ করবে। অন্তত অপুর তো ভালো লাগবে।
সেই ভেবে অপু লোকটাকে বলল- ঠিক আছে আমি দেখছি।
যেরকম কথা সেরকম কাজ। পরের দিনই প্রধান শিক্ষক থেকে অনুমতি নিয়ে অপু 'Let's reclaim our waters' বলে একটা নোটিশ দিয়ে দিল: পরীক্ষার পর সবাই যেন এত তারিখ শিবসাগরের সামনে জমায়িত হয়। Only classes 8 to 12. Should be a good swimmer ইংলিশেই নোটিশ দিল- স্কুল এ সবাই বাংলা পড়তে পারে না। অনেকের মাতৃভাষা হিন্দী বা ককবরক।' মা বাবার সম্মতি আবশ্যক। ভাই বোন , বন্ধুদের নিয়ে আসতে পারো। ' RSVPর জন্যে অপু একটা নতুন email একাউন্ট ও খুলল। ভাবছে ছুটি হলে একটা ওয়েবসাইট বানাবে saveshivsagar.com বলে। যদি কেউ আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চায় সেটাও ভালো। পাম্প ভাড়া করতে, ভলান্টিয়ারদের জলখাবারের ব্যাবস্থা করতে কিছু প্রয়োজন হতে পারে।
প্রথম মিটিং এর দিন গিয়ে দেখল শিবসাগরে যেন মেলা বসেছে - স্কুলের অনেক সিনিয়র, জুনিয়রদের চিনতে পারল। অঙ্ক স্যারও ছিলেন। পাড়ার লোক, কিছু অপরিচিত চেহারা। পাম্পিং মেশিন আনার ব্যাবস্থা তাদেরই দায়িত্ব। যথা সময়ে ট্রাক করে এনে ফিট করে দেবে পুকুরের জল খালি করতে, কিন্তু তার আগে পানা পরিষ্কার করতে হবে। আর জল শুকিয়ে গেলে ড্রেজিং করতে হবে- অবায়ুজীবী জীবাণুগুলো পুকুরের মাটি বিষাক্ত করে দিয়েছে - সেটা সরাতে হবে । কিছু Fishery department এর লোকেদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ওরাও সাহায্য করবে বলেছে পুকুরের ecosystem পুনরূদ্ধার করতে। কদিনে কিছু sponsor ও পেয়ে গেছে। প্রজেক্টটার যেন নিজস্ব একটা প্রাণ আছে। বাবার একজন সাংবাদিক বন্ধু স্থানীয় সংবাদপত্রে একটা অনুচ্ছেদ লিখেছেন- 'একটি কিশোরের স্বপ্ন'। লেখার শেষে তার প্রজেক্ট এর email id । সেটা পড়ে অপরিচিত অনেকেই নানা ভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন খুব মহদাশয় উদ্দেশ্য।
অপু কিন্তু নিজেকে আবেগপ্রবণ মনে করে না। তার মনে হয়েছিল একটা কিছু করার প্রয়োজন। অথচ লোকজন তাকে বাহবা দিচ্ছে- এটা কেমন অস্বস্তিকর। তবে তার এই ভাবমূর্তি যদি মানুষকে প্রেরণা যোগায় , শিবসাগর ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে তাতে অপুর কোন দুঃখ নেই। প্রকল্পটা অপুর ব্যক্তিগত বিশ্বাস -অবিশ্বাসের অনেক ঊর্ধ্বে।
কিছু দিন সময় লাগলো, শিবসাগরের পূর্ব গৌরব কিছুটা উদ্ধার হল । এখন পানা নেই, পাখিরা সব ফিরে এসেছে। অপু অঙ্ক স্যারের বাড়ি যেতে যেতে ভাবলো- আরও কাজ বাকি।
গল্পটার প্রথম অংশ যখন Facebook এ দি, সুজয়াদি তার মেয়ে পাখিকে সেটা পড়ে শোনায়। তখন তার কত প্রশ্ন- 'ভূতের এত হাঁচি হয় কেন ? ভূতের মা ওকে ওষূধ দেয় নি কেন? ' আমি তো লিখে খালাস। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে এটা গুরু দায়িত্ব। মা মেয়ের সম্পর্ক যেন চিরদিন এমনি থাকে, আর পাখির অনুসন্ধিৎসা যেন কখনো কম না হয় সেই প্রার্থনা করি...
পাখির জন্যে
ভূতের হাঁচি
ভুতের খুব মন খারাপ। তার হাঁচি হয়েছে শুক্রবার থেকে, এখনো যায় নি। অথচ হাঁচি নিয়ে সে ঠিক গিন্নির জন্যে পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতে পারছে না। মাছের কাছে গিয়ে হাঁচি দিলেই সব পো-পো করে পালাচ্ছে। আর এ তো মানুষের হাঁচি না, এ হলো ভুতের হাঁচি - এক সঙ্গে ৩০- ৪০ টা তো হবেই। তাই সে নাজেহাল। খুব মন খারাপ করে বুড়ো বটগাছের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে, আর ভাবছে যে কি করা যায়।
তখন রাত ১০ টা হবে, অপু মাস্টারমশাই এর বাড়ি থেকে অঙ্ক করে ফিরছিল। খুব কঠিন একটা অঙ্ক তার মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই তার সমাধান মিলছে না, কিন্তু মাস্টারবাবুর খুব বিশ্বাস- কেউ যদি পারে তবে অপুই পারবে। তাই সে খুব চিন্তিত। সবাই জানে অঙ্ক স্যার খুব কড়া , কিন্তু অপু কে খুব ভালবাসেন। অপু বাধ্য ছেলে। রোজকার পড়া করে, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ভূগোল আর অঙ্ক তার খুব প্রিয় বিষয়। সে দিন রাত এটলাস ঘাটাঘাটি করে আর অঙ্ক কষে যায়। বাংলায় কম নম্বর পায় বলে মার খুব মন খারাপ। উনি বলেন- 'বাঙালির ছেলে ভালো বাংলা লিখতে না পারলে কেমন লাগে?' বাবা বলেন: 'আহা! ওর যা ভালো লাগে পড়তে দাও না! বড় হলে যখন ভাষাটা বুঝতে শিখবে তখন নিজে থেকেই বাংলা সাহিত্য পড়বে। '
অপুর দিদি কিন্তু ইয়া মস্ত-মস্ত গল্পের বই, উপন্যাস পড়ে শেষ করে দেয়। ছুটির দিনে কখনো উপুর হয়ে, কখনো জানালার কার্নিসে বসে, চশমা চোখে দিদি সকাল থেকে সন্ধ্যে খালি গল্পের বই পড়ে। মা তখন ডেকে ডেকে হয়রান। 'চান করতে যাও, খেতে এসো , এবার বই রেখে একটু ঘুমও , চোখটা আরো যাবে- এবার একটু বিশ্রাম দে,' ইত্যাদি ....
অপু ফিকফিক করে হাঁসে। তখন দিদির পায়ে আরশোলা ছেড়ে দিলেও দিদি বুঝতে পারবে না। যেন ধ্যান করছে! অপু মজা করে বলে - 'দেখিস বাল্মীকির মত উইঢিপি হয়ে যাস না যেন!' তাই শুনে দিদি শুধু বলে- হু!
***
এমন করেই অপুর দিন কাটছিল। সেই দিন রাতের কথায় ফিরি। অপু সাইকেল চালাতে পারে তাই আর ছোটবেলার মত বাবাকে নিতে আসতে হয় না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সে দিব্যি কলেজ টিলা- যেখানে স্যারের বাড়ি সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসে। স্যারের বাড়িটা একটা পুকুরের ধারে। স্যারকে বলতে শুনেছে যে সেই পুকুরের নাকি এক কালে খুব মাছ ছিল- কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মাছের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। আগে বিকেলে দাড়িয়ে অনেক রকম মাছের খেলা দেখা যেত। এখন কচুরিপানায় সব ঢেকে গেছে। মাছ হয়ত কিছু আছে , তবে পানার জন্যে কিছু দেখা যায় না। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অপু পড়েছিল : পানার দরুন জলের তলায় সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সালোকসংশ্লেষ বা photosynthesis হ্রাস পায় , আর তার জন্যে অন্যান্য উদ্ভিদ আর জলজ জীবন বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু অপু জানে তার দিদির সেই ফুল খুব পছন্দ। একদিন অপু মনে করে দিদির জন্যে নিয়ে যাবে।
কলেজ টিলা নাম কেন বলি। ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরার রাজা মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য একটি কলেজের স্থাপনা করেন। তাঁর নামেই কলেজ হয়, সংক্ষিপ্তে এম. বি.বি কলেজ।কলেজের একপাশে কলেজে কর্মরত অধ্যাপক ও অন্যান্য কর্মচারিদের জন্যে কিছু বাসভবনের নির্মান করা হয়। কলেজ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা একটি টিলার ওপর অধিষ্ঠিত হওয়ায় অঞ্চলটার নাম পরে কলেজ টিলা। টিলার নিচে একটা ক্লাব আছে - মডার্ন ক্লাব। সেখানে দূর্গা পুজো হয়। পুকুরের ওপর মাচা লাগিয়ে ঠাকুর রাখা হয়। আবার সেই পুকুরের জলেই বিসর্জন।
স্যারের বাড়ি থেকে সাইকেল করে আসতে কলেজ পেরিয়ে একটা শুনশান রাস্তা। দিনের বেলায় কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সেখানে ভিড় থাকে । সাইকেল, রিক্সা, গাড়ি; চানাচুর, চা, ফুচকার ষ্টল; ফেরিওয়ালা, অটোওয়ালা - সব মিলে বেশ রমরমা। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই সব চুপচাপ। রাত ৮ টায় মনে হয় বুঝি মধ্যরাত। নৈশ বিদ্যালয়ে কিছু বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষা হয় হয়ত- কিন্তু তাদের কোন সাড়া শব্দ নেই।
অপু তখনো অঙ্ক নিয়ে ভেবে যাচ্ছিল । সাইকেল চালাবার কথা তার মনেই নেই। কিছু দূর এসে খেয়াল হল যে সাইকেলের টায়ার টা puncture হয়ে গেছে।কি আর করা যাবে, অগত্যা পায়ে হেঁটেই সে টিলা থেকে নামার উদ্যোগ করল। ক্লাবের কাছে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান আছে, কিন্তু সেটা হয়ত এত রাতে খোলা থাকবে না। ক্লাবে অনেক সময় তার বন্ধু হাবুল কেরাম খেলে। তার কাছে সাইকেলটা রেখে না হয় একটা রিক্সা করে বাড়ি ফেরা যাবে। ক্লাব ঘরের সামনে এক আধটা রিক্সা হয়ত এখনো পাওয়া যাবে- এ সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অপু চলছিল।হঠাৎ ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাঁচি শুনতে পেল। প্রথমে হাঁচি মনে হলেও, সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিল না। এক সঙ্গে এত কেউ হাঁচতে পারে নাকি?
সে আবছা চাঁদের আলোয় দেখল কে যেন বুড়ো বটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পাগল টাগল না তো? লোকটা পরে গিয়ে আছাড় খেলে আর রক্ষা নেই। টিলা গড়িয়ে সোজা পুকুরের জলে- ঝপাৎ। অপু একটু জোর গলায় বলল: কে? কে ওখানে?
আরেকটা হাঁচি।
আচ্ছা আহাম্মক তো - জবাব ও দেয় না।
অপু আবার বলল- এত রাতে গাছে চড়েছেন কেন- পরে গেলে ব্যাথা পাবেন।
উত্তর এলো- হুজুর মাপ করবেন, শরীরটা ভালো নেই, তাই একটু জিরচ্ছিলাম।
অপু: ও, তো শরীর খারাপ যখন বাড়ি গেলেই পারেন। রাত বিরেতে গাছে চড়ার শখ কেন হল ?
-আজ্ঞে , বাড়ি গেলে বউ বড় ধাতানি দেবে- আজ ও মাছ পেলাম না।
- মাছ পান নি তো কি হয়েছে, আজ নিরামিষ খেয়ে নেবেন
-নিরামিষটা ঠিক পোষে না। কচি পাঁঠার ঝোল হলে একটু কব্জি ডুবিয়ে খেতাম গরম গরম ভাত দিয়ে- সঙ্গে একটা গন্ধরাজ লেবু।প্রথম পাতে যদি একটা ইলিশ মাছ ভাজা আর সোনা মুগের ডাল পরে তাহলে আহা- আত্মাটা খুব তৃপ্তি পেত। কিন্তু বলি কি- গরীবের কপালে কি এসব জোটে? এখন পান্তা ভাতে একটু ঘি পরলেই গন্ধে গন্ধে খেয়ে নি।
অপু ভাবলো- এ খেয়েছে- এ তো খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল- আরও দেরী হয়ে যাবে যে !
লোকটা মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেই বলল- তা বাপু এত রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
অপু ভাবলো- কি বলবে? অনেক ভেবে সত্যি কথাটাই বলল - সাইকেলটার পান্চার হয়েছে , তাই হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
-ও। সে তো অনেক পথ। কেষ্ট-এর দোকান ও তো বন্ধ হয়ে গেছে হবে। দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। বলে লোকটা এক লাঁফে গাছ থেকে নেমে পড়ল।
লোকটা দেখতে বড্ড রোগা ভোগা - সত্যি মনে হচ্ছে অসুস্থ। পরনে খাটো করা ধুতি আর ময়লা চাদর। গায়ের রং মিশমিশে কালো। চেহারাটা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না তবে দাঁত গুলো ধবধবে সাদা। এ তো দিব্যি টুথপেষ্ট বা চুয়িং গামের বিজ্ঞাপন করতে পারে।
অপু বলল- আপনি পারবেন ঠিক করতে?
লোকটা মুচকি হেসে বলল- তা আমি পারব।
লোকটার কিন্তু ততক্ষণে হাঁচি কমে গেছে।
সে সটান মাটিতে শুয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করল। এরপর বলল,
- এ দেখুন, কি বলেছিলাম?
অপুর তো মুখ হাঁ ! এ কি করে সম্ভভ? ভুল দেখছি না তো? ওর হাতে কি কোনো ছোট পাম্প ছিল? চাদরের তলায়? না। হলে সে দেখতে পেত।
মুখে তারিফ করে বলল- বাঃ ! এমন তো কখনো দেখিনি। তোমার তো এলেম আছে দেখছি !
লোকটা আবার হে হে করে একটু হাসলো, ঘাড়টা একটু কাৎ করে বলল : অভয় দেন তো একটা কথা বলি?
অপু: কি?
- আজ্ঞে আগে কথা দিন রাগ করবেন না, বা হুট করে পালিয়ে যাবেন না?
-পালাব কেন?
- না, মানে বলা যায় না তো - অনেক দিন পরে একটা মানুষ পেয়েছি যে আমাকে দেখতে পেয়েছে- তাই খুব আল্লাদ হচ্ছে। পাছে কোনো বেআদবি করে বসি।
- এসব কেন বলছেন- আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।
- তবে একটা কথা বলি শুনুন - আমি ভূত
- ভূত মানে? ভূতনাথ ?
- না, মানে আমি ভূত
- মরে গিয়ে যে হয়?
-ছি ছি ! এসব কথা কইছেন কেন? আমাকে কি মৃত মনে হচ্ছে ?
-তাহলে?
-না মানে, আপনাদের ইস্কুলে পড়ায় না -তরঙ্গদৈর্ঘ্য?
-wavelength?
-ধরুন আমি অন্য কোনো wavelength এ থাকি।কিন্তু সাধারণ মানুষ আমাকে দেখতে পায় না কেন না তাদের মস্তিষ্ক সজাগ নয়। অন্য সময় আপনি হেঁটে গেলে আপনিও হয়ত আমাকে দেখতে পেতেন না। কিন্তু আপনার স্নায়ু হয়ত কোনো কারণে উত্তেজিত বা অতিসক্রিয়।
-হ্যাঁ, আমি একটা অঙ্ক নিয়ে ভাবছিলাম বটে।
অপু সাহসী ছেলে। ভুতের ভয় তার নেই। ভূত কেন, ব্রহ্মদত্যির ভয় ও নেই।
তাই সে জিজ্ঞাস করলো -তাহলে কি আমি তোমাকে কাল বা পরশু দেখতে পারব না?
-একটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
-কিরকম?
-আপনি কোন নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত সময়ে আবার এখানে আসবেন - যদি দেখা হয় তাহলে এটার একটা নিস্পত্তি হবে। আমারও কথা বলার লোক জুটবে।
অপু বলল- বেশ তো !
পরের শুক্রবার তাকে স্যারের বাড়ি আবার আসতে হবে, ফেরার পথে না হয় লোকটার সঙ্গে দেখা করে যাব।
সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে তাড়াতাড়ি প্যাডেলে পা ফেলল ।
***
অপুর আসতে দেরী দেখে মা একটু চিন্তিত ছিলেন, ভাবছিলেন একবার স্যারের বাড়িতে ফোন করবেন কিনা। অঙ্ক স্যার অনেক সময় বাকিদের পড়া হয়ে গেলেও অপুকে নিয়ে বসে থাকেন। মাসের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে কত বার শুনতে হয়েছে: 'দিদি এসব কেন করেন? অপুকে আমি ছাত্র হিসেবে পেয়েছি- এটাই আমার সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি। টাকা পয়সা দিয়ে গোল বাঁধান কেন?' অপুর মা তাও স্যারের হাতে খামটা গুজে দিয়ে আসেন। উনি নিজে শিক্ষিকা, স্যারের মনভাব ভালই বোঝেন কিন্তু অপুর জন্যে উনিও খুব খাটেন।তাঁর জন্যে কিছু করাটা তো কর্তব্য।
ঠিক সেই সময়ই সদর দরজা দিয়ে অপু ঢুকলো। মা বললেন: কি রে, আজ এত দেরী? হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খাবি আয়।
মায়েরা যেমন হয় - মাথায় যত চিন্তাই থাকুক- খাবারটা আগে খাইয়ে নেয়।
***
শুক্রবার যেন আসেই না, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মনটা চলে যাচ্ছিল বটগাছের সেই লোকটার কাছে। সে কি সত্যিই তাকে দেখেছিল? দিনের আলোতে সেই মোলাকাত কেমন মনগড়া মনে হচ্ছিল- হয়ত চলতে চলতেই সে কিছুক্ষনের জন্যে ঘুমিয়ে পরেছিল আর সাময়িক অর্ধচেতনায় সেই চরিত্রের উৎপত্তি। আবার না গেলে বোঝা যাচ্ছে না।
পরিকল্পনা মাফিক সে শুক্রবার পড়ার শেষে বটগাছের তলায় দাড়ালো। লোকটা যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে আরেকটু বেশি রুগ্ন মনে হল । এবার অপুর একটু চিন্তা হলো- লোকটা অসুস্থ। ডাক্তার দেখেয়িছে কিনা কে জানে? একবার ভাবলো মানিব্যাগে যা আছে ওকে দিয়ে বিদায় করবে আর ওষুধ-পথ্যির আয়োজন করতে বলবে।
লোকটা যেন আন্দাজ করেই আচমকা বলে উঠলো - মানুষের টাকা আমার কোনো প্রয়োজনে আসে না, আমি তোমার কাছে অন্য সাহায্য চাই।
-কি বলুন? (আজ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। কাল তুই বলবে না তো?)
-তুমি তো শিবসাগর দেখেছ - কখনো ভেবেছ যে কত প্রাণ তার ওপর নির্ভরশীল?
-ওই পানাপুকুরের নাম বলছেন? তার নাম শিবসাগর জানতাম না তো !
-হ্যাঁ, সব পুকুরের একটা নাম আছে, চরিত্র আছে । সব জলাসয় তো আর প্রাকৃতিক না, কিছু মনুষ্যনির্মিতও আছে - যেটা ঘটা করে নির্মান হয় , কিছু দিন তার উপযোগিতার মূল্যও থাকে, এরপর মানুষ ভুলে যায়, উপেক্ষা করে। কিন্তু সেই জলাশয়ে যে প্রাণের সঞ্চার হয় তার দায়িত্ব কার? সেই মাথাব্যাথা কেউ নেয় না কেন? অদূরদর্শিতায় যে মানুষ নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে সে কথা কজন জেনেও স্বীকার করবে? স্বীকার করলেই তো দায় বাড়বে!
লোকটা আরও বলল-আমি হাকিম দেখাতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন যে আমার এলার্জি আছে - চারিদিকে প্রাণীদের যে হাহাকার হচ্ছে সেই সব আমার তন্ত্রে অতিপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তার ফলে অনবরত হাঁচি হচ্ছে। মানুষের সে সব চিৎকার কানে আসে না বলে তারা অগ্রাহ্য করতে পারে, আমি পারি না অথচ আমার করার ক্ষমতাও খুব সীমিত - মানুষ না চাইলে আমি মন্দ ও করতে পারি না, ভালো ও করতে পারি না।
অপু আরেকবার লোকটাকে দেখল- কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে- ধুলো মাখা শরীর। চোখগুলো বড় বড়, উদাস দৃষ্টি । কাকে যেন এমন দেখেছে। এ জন্যেই তো এতক্ষণ দাড়িয়ে সে পাগলের প্রলাপ শুনছিল। এতক্ষণে সে বলল- কিন্তু আমি কি করতে পারি?
লোকটা বলল- তুমিই পারবে। আমি জানি। তোমার প্রাণশক্তি অনেক। সেই শক্তির সদ্ ব্যাবহার কর- অন্যের উপকার কর- নিজেও উপকৃত হবে।
লোকটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলল। শুনে অপু কিছুটা খুশি হলো- কেউ তাকে এত ভরসা করছে শুনে তার মনের জোরটা বেশ তেজ হলো। পাগলই হোক না কেন। সে অনেক বার নিজেও ভেবেছে পুকুরটার জন্যে কিছু করা উচিত। সে একা পারবে না - বন্ধুদের সাহায্য চাই। স্কুলের নোটিশ বোর্ডে একটা বিজ্ঞপ্তি দেবে ভাবছে -স্বেচ্ছাসেবক চাই। Socially Useful Productive Work (SUPW) ক্লাসের স্যারকেও বলতে হবে আর অঙ্ক স্যারকেও। পরীক্ষা শেষ হলেই গ্রীষ্মের ছুটি- তখন ছেলে মেয়েরা একটা প্রজেক্ট পেলে উৎসাহী বোধ করবে। অন্তত অপুর তো ভালো লাগবে।
সেই ভেবে অপু লোকটাকে বলল- ঠিক আছে আমি দেখছি।
যেরকম কথা সেরকম কাজ। পরের দিনই প্রধান শিক্ষক থেকে অনুমতি নিয়ে অপু 'Let's reclaim our waters' বলে একটা নোটিশ দিয়ে দিল: পরীক্ষার পর সবাই যেন এত তারিখ শিবসাগরের সামনে জমায়িত হয়। Only classes 8 to 12. Should be a good swimmer ইংলিশেই নোটিশ দিল- স্কুল এ সবাই বাংলা পড়তে পারে না। অনেকের মাতৃভাষা হিন্দী বা ককবরক।' মা বাবার সম্মতি আবশ্যক। ভাই বোন , বন্ধুদের নিয়ে আসতে পারো। ' RSVPর জন্যে অপু একটা নতুন email একাউন্ট ও খুলল। ভাবছে ছুটি হলে একটা ওয়েবসাইট বানাবে saveshivsagar.com বলে। যদি কেউ আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চায় সেটাও ভালো। পাম্প ভাড়া করতে, ভলান্টিয়ারদের জলখাবারের ব্যাবস্থা করতে কিছু প্রয়োজন হতে পারে।
প্রথম মিটিং এর দিন গিয়ে দেখল শিবসাগরে যেন মেলা বসেছে - স্কুলের অনেক সিনিয়র, জুনিয়রদের চিনতে পারল। অঙ্ক স্যারও ছিলেন। পাড়ার লোক, কিছু অপরিচিত চেহারা। পাম্পিং মেশিন আনার ব্যাবস্থা তাদেরই দায়িত্ব। যথা সময়ে ট্রাক করে এনে ফিট করে দেবে পুকুরের জল খালি করতে, কিন্তু তার আগে পানা পরিষ্কার করতে হবে। আর জল শুকিয়ে গেলে ড্রেজিং করতে হবে- অবায়ুজীবী জীবাণুগুলো পুকুরের মাটি বিষাক্ত করে দিয়েছে - সেটা সরাতে হবে । কিছু Fishery department এর লোকেদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ওরাও সাহায্য করবে বলেছে পুকুরের ecosystem পুনরূদ্ধার করতে। কদিনে কিছু sponsor ও পেয়ে গেছে। প্রজেক্টটার যেন নিজস্ব একটা প্রাণ আছে। বাবার একজন সাংবাদিক বন্ধু স্থানীয় সংবাদপত্রে একটা অনুচ্ছেদ লিখেছেন- 'একটি কিশোরের স্বপ্ন'। লেখার শেষে তার প্রজেক্ট এর email id । সেটা পড়ে অপরিচিত অনেকেই নানা ভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন খুব মহদাশয় উদ্দেশ্য।
অপু কিন্তু নিজেকে আবেগপ্রবণ মনে করে না। তার মনে হয়েছিল একটা কিছু করার প্রয়োজন। অথচ লোকজন তাকে বাহবা দিচ্ছে- এটা কেমন অস্বস্তিকর। তবে তার এই ভাবমূর্তি যদি মানুষকে প্রেরণা যোগায় , শিবসাগর ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে তাতে অপুর কোন দুঃখ নেই। প্রকল্পটা অপুর ব্যক্তিগত বিশ্বাস -অবিশ্বাসের অনেক ঊর্ধ্বে।
কিছু দিন সময় লাগলো, শিবসাগরের পূর্ব গৌরব কিছুটা উদ্ধার হল । এখন পানা নেই, পাখিরা সব ফিরে এসেছে। অপু অঙ্ক স্যারের বাড়ি যেতে যেতে ভাবলো- আরও কাজ বাকি।
7 comments:
Hello Ma'm, This is Ravikumar and i follow your posts on fb. Can i get English translation of above story? I would like to read it. BTW, your posts are thought provoking and most of the time i feel the same on the subjects like woman empowerment.
Anyway its pleasure following you on fb.
I will post a translation as soon as I can. Thanks for your follow Ravi.
Thank you for reading it to me !! Awesome story. I loved it. It reminded of all those Anandamela stories my mom used to read it to me during Puja.
Technically speaking, I like the part where you say that the "allergy was induced by sound waves (living organisms in the lake - they have their own frequency, which a normal human being can't perceive, but the ghost was able to hear it) " makes you think if humans were able to perceive or sense these frequencies, they would have been more responsible of the environment.
Sangram, we will have many more such reading sessions. The reading aloud helps me to edit the stories when something doesn't sound right to my ears. I know it appears far-fetched- sound waves causing allergic reactions, however, I can't help but wonder what if it were true. Apathy makes us cruel.
Loved reading the story...picturesque description of bhooter hanchi , apur mathai anker ana gona, college tilla sotti khub appreciable!Chhoto belar bangla golpo mone pore gelo..You are equally a pro in Bangla too! khub sundor shabdo chayan and presentation...keep us posted.laptop er absence e porte deri hoye gelo..all the best for its Puja Publication ! Love Always
Thanks for the kind words boudi. I don't write Bangla frequently. The last time I did was in March when I wrote a letter to my mother-in-law. As a result, there is a dire need of a proof reader for my compositions. If you or any of the readers find a spelling mistake or grammatical error, please let me know so that I can correct it. XOXO
দারুন হয়েছে, আজ-ই পড়লাম
Post a Comment