জেঠিমা মারা যাবার পর
জেঠামশাই ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। জেঠুর ছেলে পুলে
নেই। ভাই
বোনদের বিয়ে দিয়ে
যখন নিজে বিয়ে
করলেন তখন বিয়ের
বয়েস কবেই পেরিয়ে
গেছে। সন্তান সন্ততি বলতে চার ভাইএর একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে মেয়েরা। জেঠুর কাছে বায়না করলেই পাওয়া যায় বলে জেঠুকে সবাই ভালোবাসত। জেঠিমা খুব চুপ চাপ ছিলেন। অসুখ হয়ে মারা যাবার পর জেঠুর জন্যে মন খারাপ হল সবারই। ভালোবাসা কখনো করুণার স্রোতে বাড়ে কিনা।
জেঠু উত্তর ঘরে একা শোন বলে বাড়ির
মালিকে বলা
হল রাতে উত্তরের
দালানে শুতে। জেঠুর শোবার ঘর দোতালায়। নিচে ঘরে ডাক্তারের চেম্বার। খুব অল্প বয়েসেই হোমিওপ্যাথির ডাক্তারি করে নাম করেছিলেন। কিন্তু
স্ত্রী বিগত হয়েছেন অবধি চেম্বারে তালা। পুরোনো রোগী কেউ এলে এটা ওটার পুরিয়া
বানিয়ে দেন কিন্তু
আগের মত সেই
উৎসাহ কিছুতেই নেই।
খাওয়া দাওয়া ও খুব
কমে গেছে।
ক্রমেই তিনি রোগা
ভোগা দেখতে হয়ে
গেলেন। গলার স্বরও যেন
কেমন বদলে যেতে
লাগল। রাতারাতি
বুড়িয়ে যাওয়া মানুষকে
দেখে যেমন আঁতকে
ওঠে লোকে, পুরোনো
পরিচিতরা জেঠুকে দেখে
সেই প্রতিক্রিয়াই করতেন। অনেকেই নিজেই ডাক্তারি করে বলতেন- ক্যালি
ফোস বা গেলসেমিয়াম
খান না কটা
!
জেঠু হেসে বলতেন আর
আমার জীবনের ক্যালি ফোসই তো ফুস
করে পালিয়ে গেল, এখন আর ওষুধ খেয়ে
কি হবে ?
আমরা ভাই বোনরা মিলে ঠিক করলাম যে
জেঠুর নিঃসঙ্গতা কাটানোর
জন্যে একটা কুকুর
এনে দেব। পাড়ার ভুলোদের বাড়ির
কুকুরটা তিনটে ছানা দিয়েছেল। সেগুলো একটু বড়
হলেই একটা নিয়ে
আসা হবে ঠিক
হল।
যে কথা, সেই কাজ। কুকুর ছানাটা
কুঁচকুঁচে কালো বলে তার
নাম রাখা হল
কালু। প্রথম
কালুকে নিয়ে গিয়ে
জেঠুর পায়ের কাছে
রাখা হল। জেঠু দোতালার ইজিচেয়ারে বসে পত্রিকা
পড়ছিলেন। বিকেলে
চা খেতে খেতে
পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা তখনো ছিল। কালু জেঠুকে দেখে
আহ্বলাদে আধখানা। মনের আনন্দে লেজ নাড়তে নাড়তে
এক পা তুলে
হিসি করে দিল। সেই দেখে
জেঠু বলে উঠলেন
- ওরে, ব্যাটার পেটে
লিক আছে !
সেই নিয়ে আমরা খুব
হাসা হাসি করলাম।
কালু আসাতে ভালোই হল। বিকেলে স্কুল
থেকে এসে ফুটবল
খেললে সেও পায়ে পায়ে হেঁটে অনেক চেষ্টা
করত গোল দিতে। ক্রিকেট খেললে
বল কুঁড়িয়ে আনত বাগান থেকে।
অনেক সময় হিংসুটিপনাও
করত। মুখ
থেকে বল দিতে
চাইত না। অনেক
কাকুতি মিনতি করে
গায়ে মাথায় হাত
বুলিয়ে তোষামোদ করলে তবেই
সে বল দিত।রাত হলে খাবার খেয়ে কালু দোতালার বারান্দায় শুয়ে পাহারা দিত। মালির সঙ্গেও তার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল।এই রকম করেই আমাদের
দিন কাঁটছিল।
চেম্বার বন্ধ থাকার দরুণ
ঝাড় পোঁছ আগের
মতো হত না । ঝি মাঝে
মাঝে গিয়ে দরজা
জানলা খুলে ঝুল
কালি পরিষ্কার করত। একবার হল
কি, আমার চার
বছরের খুড়তুতো বোন
উঠোনের ধারে খেলছিল। ওষুধ পত্র থাকত বলে
আমরা কেউই চেম্বারে বিশেষ যেতাম না। তাই ভেতরটা
দেখার কৌতূহলও খুব
থাকত। খুকিরও বোধ
হয় তাই। সেই
বয়েসে মানা করার কারণ
বোঝানোও শক্ত। সে করল
কি -ঝি পোঁছা
দিয়ে এক বালতি
কাদা জল ফেলতে
কলপার গেল নতুন জল আনবে
বলে আর খুকি
গুটি গুটি পায়ে
চেম্বারে ঢুকে পড়ল।
তাই দেখে কালুর কি
চেঁচামেচি ! সে ছুটে গিয়ে
চেম্বারে কাকে খুব
বকতে লাগলো।
হাঙ্গামা শুনে আমরা
খেলা ছেড়ে উত্তর
দালানের দিকে দৌঁড়ে গেলাম। গিয়ে
দেখি খুকি দুয়ারে
বসে কাঁদছে।
আর কালু ভীম
বিক্রমে এক কালো
কেউটের সঙ্গে ঝগড়া করছে আর খুব বকছে। চেম্বার অনেক দিন বন্ধ থাকায় ইনি এসে আস্তানা গেড়েছেন। কেউটে ফণা তুলে কালুকে এই কামড়ায় কি সেই কামড়ায়। দু তিন বার ছোবল মারার ব্যর্থ চেষ্টাও করল। কিন্তু কালু আমাদের ব্ল্যাক কমান্ডো। তাকে নাগাল পাওয়া ভার। অনেক পুরোনো বাড়িতে বাস্তুসাপ থাকে ঠিকই
কিন্তু এখানে তো
মানুষের বাস আছে। বিষাক্ত সাপ থাকলে সর্বনাশ!
সঙ্গে সঙ্গে লাঠি সোঠা
এনে সেই সাপ
তাড়ানো হল।
বাড়ির পশ্চিম দিকে
একটা পুকুর ছিল
সেই দিকে সাপটা
পালাল। বাড়ির চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড দেওয়া হল। আর সবাইকে সাবধান করা হল চোখ কান খোলা রাখতে। কিছু দিন আমরা রাতে টয়লেট যেতে সঙ্গে টর্চবাতি, লাঠি আর মালিকে ডেকে নিয়ে গেলাম ।
কালুকে সাপে কেটেছে কিনা
দেখে জেঠু ওর
মাথায় হাত বুলাতে
বুলাতে সস্নেহে বললেন
- আজ থেকে তোর
নাম বীর বাহাদুর
কালু সর্দার।
কালু বলল - উফ!
এই ঘটনার পর একটা
জিনিস হল - ভারতবৰ্ষে
সাপের কামড়ে যে
প্রতি বছর ৪৬,০০০
এরও বেশি লোক
মারা যায় সেটা
জানতে পেরে জেঠু
উঠে পরে লাগলেন
এন্টি-ভেনম কিনে
এনে গ্রামে গঞ্জের হাসপাতালে বিতরণ করতে।
অনেক দিন পর
তিনি যেন জীবনে
নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে
পেলেন।
No comments:
Post a Comment