সবে ডাক্তারি পাশ করে রায়পুরে সরকারি হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছি ।
গ্রামে তখন লর্ড সিনহাদের জমিদারি । ট্রেনে করে যখন প্রথম রায়পুর পৌছালাম, তখন সূর্যদেব কুয়াশার আড়ালে মুখ ঢেকে রেখেছে । কিছু ভোরের পাখি ছাড়া আর চারিদিকে কোন শব্দ নেই । স্টেশনেই জলখাবার সেরে রওনা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে । ইচ্ছে ছিল জয়েন করে, হাসপাতালে দিনটা কাটিয়ে এরপর গিয়ে সরকারি আবাসে মাল সমেত একেবারে উঠব ।
দপ্তরী কাজ মিটিয়ে যখন কিছু রোগী দেখা হয়ে গেছে তখন জমিদারবাড়ির এক পেয়াদা এসে
খবর দিল যে আমার সান্ধ্যভোজনের আয়োজন আজ জমিদারবাড়িতে হয়েছে । আর জমিদার বাবু হুকুম করেছেন যেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হয় । যখনকার কথা বলছি তখন টেলিফোনের ওত চল ছিল না কিন্তু মানুষের আতিথেয়তা ছিল অতুলনীয় । কাজেই, নবাগত আগন্তুককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো খুব একটা অসাধারণ কিছু ছিল না । সারাদিন পরিশ্রম করে আমার খিদেটাও বেশ চাড়া দিয়ে উঠেছিল তাই আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে জমিদারের আজ্ঞাবাহীর সঙ্গে জমিদারবাড়ি উপলক্ষে রওনা দিলাম ।
রাস্তায় যা দৃশ্য দেখলাম তাতে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল । লক্ষী সরোবরে তখন শীতকালের কিছু পরিযায়ী
পাখি জটলা পাকিয়ে মেলা হইচই করছে । যেন পাখিদের অর্কেস্ট্রা প্র্যাকটিস ।স্ফটিকের মতো স্পষ্ট
জলে তখন সূর্য অস্তের নৈসর্গিক মুহূর্ত প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল । সেটা দেখে আমার সারা দিনের ক্লান্তি কোথায় বাষ্প হয়ে উড়ে গেল ।
সিনহাদের বসতবাড়ি ইট সিমেন্টের তৈরি দোতলা রাজমহল । সদর দরজা দিয়ে ঢুকে যখন প্রধান গৃহে প্রবেশ করলাম তখন এক প্রৌঢ় ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন । বুঝতে পারলাম ইনিই বর্তমান কুলপতি লর্ড বীরেন্দ্র সিনহা । ইংরেজ আমলের উপাধি এখনো থাকলেও সেই প্রতিপত্তি আর নেই । সন্ধ্যার আবছা হ্যাজাক আলোতেও দেখতে পেলাম যে দেয়ালের ছাল চামড়া উঠে নোনা ধরে গেছে আর অনেক জায়গায় মেরামতের প্রয়োজন । হয়ত উনি সংসার সম্বন্ধে উদাসীন।
বীরেন্দ্র বাবু খুব আন্তরিকভাবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বসতে বললেন ।
‘আমার অর্ধাঙ্গিনী দেহ ত্যাগ করেছেন বহু বছর । আমি ছাড়া কিছু পুরনো চাকর বাকর আছে শুধু । কাজেই কেউ গ্রামে এলে আমি কিছুটা জোর করেই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। মনের মত কথা বার্তা বলার লোক পাওয়া বড় মুশকিল এখানে। ’
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে তখন বীরেন্দ্র বাবু আমাকে বললেন যে,
‘আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বহু বছর পুরনো । নবাব আমল থেকে বংশানুক্রমে বাস করে আসছি এই বাড়িতে ।
কোনদিন কোনরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি ।কিন্তু ইদানিং এখানে ভূতের উপদ্রব দেখা দিয়েছে ।’
কিছুটা কৌতূহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, ‘ভূত? সে কি রকম?’
উনি বললেন,’ দেখুন- পাড়াগাঁয়ের লোকেরা ভয় পেলে আর তার ব্যাখ্যা করতে না পারলে কোন অশরীরী আত্মার ওপর তার দোষ চাপিয়ে দেয় । ভূত, পেত্নী, রক্তচোষা, ব্রহ্মদৈত্য, একানড়ে, মামদোভুত - কত কি মশাই !
শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকে রাজপুত্র হ্যামলেট তার মৃত পিতার আত্মার সঙ্গে কথা বলতেন, জানেন তো ? অনেক তাত্ত্বিকরা বিচার করে দেখেছেন যে সেটা হয়ত হ্যামলেটের মনের বিকার । তার মার সঙ্গে তার কাকা ক্লদিয়াসের ঘনিষ্ঠতা সে সহ্য করতে পারছিল না বলে সেটা প্রকাশ পাচ্ছিল নানারকম হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমে।
এইসব অমূলপ্রত্যক্ষ সাধারণ মানুষের অনেক সময়ই হয়ে থাকে । এক্ষেত্রে আমার বাগানের মালি, গাড়োয়ান বাবদ আমার ড্রাইভার সেই ভূতকে আমাদের দিঘির পাড়ে একাদশীর রাতে দেখেছে । দেখতে ভয়াবহ কিছুই না- একটি বালক ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়ে পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরে । তার মাছ ধরা হয় কিনা সেটা জানা যায়নি কেন না তার কাছাকাছি কেউ গেলে সে অদৃশ্য হয়ে যায় । এরপর কিছুদিন তার দেখা পাওয়া যায় না । আবার হঠাৎ করেই তার আবির্ভাব হয় । এখানের পুলিশও পাড়াগাঁয়ের লোক । ভূতের নাম শুনে তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে ।
কোন শিক্ষিত সভ্য শহুরে লোক না হলে এই কথা হয়ত আমি তুলতামই না । শেষে যদি ভয় পেয়ে আপনিও এই
বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান ! কিন্তু আপনার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে যদি কোন কৌতুহল জেগে থাকে তাহলে একটা সুরাহা করতে আমাদের সাহায্য করুন -আমার এইটুকু অনুরোধ ।
কাল একাদশী । আবার সে বালকের আবির্ভাব হতে পারে । আমি চাই আপনি হাসপাতালে পর রাতটা এখানে এসে কাটান । এবং সেরকম কিছু ঘটনা ঘটলে তাকে খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করুন ।’
ভদ্রলোক এমন আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলেন যে আমি না করতে পারলাম না । তাছাড়া সরকারের আবাস থেকে এখানে খানাপিনার ব্যবস্থাটাও অনেক বেশি উপাদেয় ।ভদ্রলোক বোধহয় কিছুটা আমার মনের ভাব আন্দাজ করেই বললেন যে ‘আপনার থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না, বরং এখানে দেখাশোনা করার অনেক লোক আছে । আপনি আরামে যতদিন চান কাটাতে পারেন ।’
অগত্যা আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং দিনের শেষে কাল আবার ফিরে আসবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মত শয্যা গ্রহণ করলাম ।
আমার ঘুম আসছিল না । হঠাৎ করে এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার পেয়ে যাব ভাবতে পারিনি । ম্যালেরিয়া টাইফয়েড এসবের ভয় ছিল বটে কিন্তু একটা ছোটখাটো গেয়ো ভূত! সেটা আশা করিনি । কোথাও যেন একটা খটকা লাগছিল । একটু খতিয়ে দেখতে হবে । আমার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে বলছে যে কোথাও একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে ।
গ্রামগঞ্জের মানুষেরা এমনিতেও অনেক ভীতু হয় । তার ওপর অন্ধ বিশ্বাসে ভরপুর । অনেক শিক্ষিত লোককেও আমি ভুলভাল বিচারধারায় আক্রান্ত হতে দেখেছি । ভুল ধরিয়ে দিলেও তাদের মনের অন্ধকার দূর করতে তারা তৎপর হয় না । যদি এই ভূতের রহস্য উদঘাটন করিও লর্ড সিনহাকে কতটা আশ্বস্ত করতে পারব জানিনা ।তবু চেষ্টা করব । যদি এটা mass hysteria হয় সেটাও নিরাময় করা যাবে ।
পরদিন হাসপাতালে কিছুতেই মন বসছিল না ।
কয়েকজন রোগী দেখার পর বারে বারে মনে হতে লাগলো জমিদার বাড়ির কথা ।
মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন যে অনেক জায়গার অনেক emotional residue অর্থাৎ কোন তীব্র আবেগের অবশিষ্টাংশ থাকে ।এবং বহুকাল পরও সেই তীব্র আবেগকে অন্য লোকেরা অনুভব করতে পারেন । যেমন কোন বাড়িতে যদি কাউকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাহলে অনেকে সেই বাড়ির ইতিহাস না জেনেও একটা মানসিক চাপ অনুভব করেন । একজন স্কটিশ নৃতত্ববিদ স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজিয়ার এর প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন । হয়ত রায়পুরের জমিদার বাড়িতে এমন কোন ইতিহাস লুকানো আছে যার রেশ এখনো অনুভব করা যায় ।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে সন্ধ্যা হওয়ার আগে একবার জমিদার বাড়ির আশেপাশে খতিয়ে দেখব ।
যারা ওখানে কাজ করে এবং ওই ভুত দেখেছে বলে মনে করে ওদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করব যে এই কাহিনীর উৎপত্তিস্থল কোথায় ।বেশি খুঁজতে হল না । বুড়ো বেণীমাধব বহু বছর ধরে জমিদার বাড়ির মালি ।
সে আমাকে বলল যে বহুকাল আগে এই বাড়িতে এক পরিচারিকা ছিল ।তার একটা আট বছরের ফুটফুটে ছেলে ছিল । জমিদারবাড়ির বর্তমান মালিক লর্ড বীরেন্দ্র সিনহার বয়সী । পিঠোপিঠি দুই বালক একসঙ্গে বড় হচ্ছিল ।অনেকটা সময়ই একসঙ্গে কাটাত । কখনো মাছ ধরে, কখনো গাছে চড়ে ফল পেড়ে, কখনো বা ঘুড়ি নিয়ে সারাদিন মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে।তখনো প্রভু আর ভক্তের সম্পর্কের মত জটিল কিছু ছিল না । অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা যেমন জাত-শ্রেণী-বর্গের পার্থক্য না করে নিজেদের পছন্দমত বন্ধু খুঁজে নেয়, তেমনি স্বাভাবিক সরল বন্ধুত্ব ।
সেই ছেলেটি দিঘির জলে ডুবে মারা গিয়েছিল । পরিচারিকাটি তার শোকে পাগল হয়ে যায় ।ওই ছেলের আত্মা নাকি এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
অপঘাতে তো অনেকেই মরে ।কিন্তু অনেক সময় অনেক নির্মম-নিষ্ঠুর গল্প আমাদের মনে দানা বাঁধে ।হয়ত অবচেতন মনে আমরা সে দুর্ঘটনার সুব্যাখ্যা খুঁজতে থাকি । আমাদের চিন্তা যত গভীর হয় তত সেই দানা এক বিশাল বৃক্ষের রূপ নিয়ে আমাদের স্নায়ুর কোণে কোণে তার অস্তিত্ব বিস্তার করে । সয়নে-স্বপ্নে-জাগরণে আমরা সেই বৃক্ষের আন্দোলন অনুভব করি । অন্য কোন চিন্তায় সেই সুখ প্রাপ্তি হয় না । এক নিষ্পাপ শিশুর অপঘাতে মৃত্যুর কাহিনী হয়ত তেমনই তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে যে তার মৃত্যুর পরেও সাধারন মানুষ তাকে জীবিত দেখতে চায়। এবং সেই ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে পর এক ধরনের mass hallucination সৃষ্টি করে ।
গ্রামের লোক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না বুঝলেও বীরেন্দ্র বাবু আমার কথা অগ্রাহ্য করবেন না এবং তার প্রজাদের হিতের জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করবেন আশা করি । নৈশভোজের পর আমি তাকে সেই মন্ত্রণাই দিলাম ।
অনেক চিন্তার পর যখন উনি কথা বললেন তখন লর্ড সিনহার কণ্ঠস্বর স্থির । ঠান্ডা ইস্পাতের মত কঠিন ।
‘আমার মা মানসিক রোগী ছিলেন । বাবাকে নানা কারণে সন্দেহ করতেন । কখনো বলতেন যে আমি তার ছেলে নই । কখনো পরিচালিকার ছেলেটি বাবার অবৈধ সন্তান বলে দাবি করতেন । মা দিনে দিনে অসুস্থ হতে থাকলে বাবা আমাকে পড়াশোনার জন্য দার্জিলিং-এ বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন ।
কিছুদিন পর ছুটিতে বাড়ি এসে খবর পাই যে আমার বন্ধু জলে ডুবে মারা গেছে । কানাঘুষো শুনতে পাই যে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার মা । আমার অনুপস্থিতিতে বাবা কিছুটা নিজের ছেলের মতই তাকে দেখতে লেগেছিলেন । তার পড়াশোনা যাতে ভালোভাবে হয় তার জন্য মুন্সিজির কাছে বলা ছিল যে স্কুলের খাতাপত্র এবং যাবতীয় খরচ যেন তহবিল থেকে দেওয়া হয় । তার জন্য বাবার অনুমতি চাই না ।
সেটা শুনে আমার মার বিকৃত মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় জানি না । তবে কিছুদিন পর তাকে দিঘির পারে দেখতে পেয়ে মা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আলিঙ্গন করে জলের তলায় নিয়ে যান । ছেলেটির মৃতদেহ উদ্ধার হলেও মাকে আর পাওয়া যায়নি । মাকে আমি অনেক আগেই হারিয়ে ছিলাম কিন্তু বন্ধুকে হারিয়ে আরো বিহ্বল হয়ে পড়লাম । তার অভাগা মায়ের আর্তনাদ এখনো এই বাড়িতে শোনা যায় ।’
শুনে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল । সত্যি সত্যি যেন কোন মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম । আর বাইরে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা ছেলে হাতে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে ।
গ্রামে তখন লর্ড সিনহাদের জমিদারি । ট্রেনে করে যখন প্রথম রায়পুর পৌছালাম, তখন সূর্যদেব কুয়াশার আড়ালে মুখ ঢেকে রেখেছে । কিছু ভোরের পাখি ছাড়া আর চারিদিকে কোন শব্দ নেই । স্টেশনেই জলখাবার সেরে রওনা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে । ইচ্ছে ছিল জয়েন করে, হাসপাতালে দিনটা কাটিয়ে এরপর গিয়ে সরকারি আবাসে মাল সমেত একেবারে উঠব ।
দপ্তরী কাজ মিটিয়ে যখন কিছু রোগী দেখা হয়ে গেছে তখন জমিদারবাড়ির এক পেয়াদা এসে
খবর দিল যে আমার সান্ধ্যভোজনের আয়োজন আজ জমিদারবাড়িতে হয়েছে । আর জমিদার বাবু হুকুম করেছেন যেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হয় । যখনকার কথা বলছি তখন টেলিফোনের ওত চল ছিল না কিন্তু মানুষের আতিথেয়তা ছিল অতুলনীয় । কাজেই, নবাগত আগন্তুককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো খুব একটা অসাধারণ কিছু ছিল না । সারাদিন পরিশ্রম করে আমার খিদেটাও বেশ চাড়া দিয়ে উঠেছিল তাই আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে জমিদারের আজ্ঞাবাহীর সঙ্গে জমিদারবাড়ি উপলক্ষে রওনা দিলাম ।
রাস্তায় যা দৃশ্য দেখলাম তাতে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল । লক্ষী সরোবরে তখন শীতকালের কিছু পরিযায়ী
পাখি জটলা পাকিয়ে মেলা হইচই করছে । যেন পাখিদের অর্কেস্ট্রা প্র্যাকটিস ।স্ফটিকের মতো স্পষ্ট
জলে তখন সূর্য অস্তের নৈসর্গিক মুহূর্ত প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল । সেটা দেখে আমার সারা দিনের ক্লান্তি কোথায় বাষ্প হয়ে উড়ে গেল ।
সিনহাদের বসতবাড়ি ইট সিমেন্টের তৈরি দোতলা রাজমহল । সদর দরজা দিয়ে ঢুকে যখন প্রধান গৃহে প্রবেশ করলাম তখন এক প্রৌঢ় ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন । বুঝতে পারলাম ইনিই বর্তমান কুলপতি লর্ড বীরেন্দ্র সিনহা । ইংরেজ আমলের উপাধি এখনো থাকলেও সেই প্রতিপত্তি আর নেই । সন্ধ্যার আবছা হ্যাজাক আলোতেও দেখতে পেলাম যে দেয়ালের ছাল চামড়া উঠে নোনা ধরে গেছে আর অনেক জায়গায় মেরামতের প্রয়োজন । হয়ত উনি সংসার সম্বন্ধে উদাসীন।
বীরেন্দ্র বাবু খুব আন্তরিকভাবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বসতে বললেন ।
‘আমার অর্ধাঙ্গিনী দেহ ত্যাগ করেছেন বহু বছর । আমি ছাড়া কিছু পুরনো চাকর বাকর আছে শুধু । কাজেই কেউ গ্রামে এলে আমি কিছুটা জোর করেই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। মনের মত কথা বার্তা বলার লোক পাওয়া বড় মুশকিল এখানে। ’
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে তখন বীরেন্দ্র বাবু আমাকে বললেন যে,
‘আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বহু বছর পুরনো । নবাব আমল থেকে বংশানুক্রমে বাস করে আসছি এই বাড়িতে ।
কোনদিন কোনরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি ।কিন্তু ইদানিং এখানে ভূতের উপদ্রব দেখা দিয়েছে ।’
কিছুটা কৌতূহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, ‘ভূত? সে কি রকম?’
উনি বললেন,’ দেখুন- পাড়াগাঁয়ের লোকেরা ভয় পেলে আর তার ব্যাখ্যা করতে না পারলে কোন অশরীরী আত্মার ওপর তার দোষ চাপিয়ে দেয় । ভূত, পেত্নী, রক্তচোষা, ব্রহ্মদৈত্য, একানড়ে, মামদোভুত - কত কি মশাই !
শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকে রাজপুত্র হ্যামলেট তার মৃত পিতার আত্মার সঙ্গে কথা বলতেন, জানেন তো ? অনেক তাত্ত্বিকরা বিচার করে দেখেছেন যে সেটা হয়ত হ্যামলেটের মনের বিকার । তার মার সঙ্গে তার কাকা ক্লদিয়াসের ঘনিষ্ঠতা সে সহ্য করতে পারছিল না বলে সেটা প্রকাশ পাচ্ছিল নানারকম হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমে।
এইসব অমূলপ্রত্যক্ষ সাধারণ মানুষের অনেক সময়ই হয়ে থাকে । এক্ষেত্রে আমার বাগানের মালি, গাড়োয়ান বাবদ আমার ড্রাইভার সেই ভূতকে আমাদের দিঘির পাড়ে একাদশীর রাতে দেখেছে । দেখতে ভয়াবহ কিছুই না- একটি বালক ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়ে পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরে । তার মাছ ধরা হয় কিনা সেটা জানা যায়নি কেন না তার কাছাকাছি কেউ গেলে সে অদৃশ্য হয়ে যায় । এরপর কিছুদিন তার দেখা পাওয়া যায় না । আবার হঠাৎ করেই তার আবির্ভাব হয় । এখানের পুলিশও পাড়াগাঁয়ের লোক । ভূতের নাম শুনে তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে ।
কোন শিক্ষিত সভ্য শহুরে লোক না হলে এই কথা হয়ত আমি তুলতামই না । শেষে যদি ভয় পেয়ে আপনিও এই
বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান ! কিন্তু আপনার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে যদি কোন কৌতুহল জেগে থাকে তাহলে একটা সুরাহা করতে আমাদের সাহায্য করুন -আমার এইটুকু অনুরোধ ।
কাল একাদশী । আবার সে বালকের আবির্ভাব হতে পারে । আমি চাই আপনি হাসপাতালে পর রাতটা এখানে এসে কাটান । এবং সেরকম কিছু ঘটনা ঘটলে তাকে খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করুন ।’
ভদ্রলোক এমন আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলেন যে আমি না করতে পারলাম না । তাছাড়া সরকারের আবাস থেকে এখানে খানাপিনার ব্যবস্থাটাও অনেক বেশি উপাদেয় ।ভদ্রলোক বোধহয় কিছুটা আমার মনের ভাব আন্দাজ করেই বললেন যে ‘আপনার থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না, বরং এখানে দেখাশোনা করার অনেক লোক আছে । আপনি আরামে যতদিন চান কাটাতে পারেন ।’
অগত্যা আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং দিনের শেষে কাল আবার ফিরে আসবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মত শয্যা গ্রহণ করলাম ।
আমার ঘুম আসছিল না । হঠাৎ করে এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার পেয়ে যাব ভাবতে পারিনি । ম্যালেরিয়া টাইফয়েড এসবের ভয় ছিল বটে কিন্তু একটা ছোটখাটো গেয়ো ভূত! সেটা আশা করিনি । কোথাও যেন একটা খটকা লাগছিল । একটু খতিয়ে দেখতে হবে । আমার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে বলছে যে কোথাও একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে ।
গ্রামগঞ্জের মানুষেরা এমনিতেও অনেক ভীতু হয় । তার ওপর অন্ধ বিশ্বাসে ভরপুর । অনেক শিক্ষিত লোককেও আমি ভুলভাল বিচারধারায় আক্রান্ত হতে দেখেছি । ভুল ধরিয়ে দিলেও তাদের মনের অন্ধকার দূর করতে তারা তৎপর হয় না । যদি এই ভূতের রহস্য উদঘাটন করিও লর্ড সিনহাকে কতটা আশ্বস্ত করতে পারব জানিনা ।তবু চেষ্টা করব । যদি এটা mass hysteria হয় সেটাও নিরাময় করা যাবে ।
পরদিন হাসপাতালে কিছুতেই মন বসছিল না ।
কয়েকজন রোগী দেখার পর বারে বারে মনে হতে লাগলো জমিদার বাড়ির কথা ।
মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন যে অনেক জায়গার অনেক emotional residue অর্থাৎ কোন তীব্র আবেগের অবশিষ্টাংশ থাকে ।এবং বহুকাল পরও সেই তীব্র আবেগকে অন্য লোকেরা অনুভব করতে পারেন । যেমন কোন বাড়িতে যদি কাউকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাহলে অনেকে সেই বাড়ির ইতিহাস না জেনেও একটা মানসিক চাপ অনুভব করেন । একজন স্কটিশ নৃতত্ববিদ স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজিয়ার এর প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন । হয়ত রায়পুরের জমিদার বাড়িতে এমন কোন ইতিহাস লুকানো আছে যার রেশ এখনো অনুভব করা যায় ।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে সন্ধ্যা হওয়ার আগে একবার জমিদার বাড়ির আশেপাশে খতিয়ে দেখব ।
যারা ওখানে কাজ করে এবং ওই ভুত দেখেছে বলে মনে করে ওদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করব যে এই কাহিনীর উৎপত্তিস্থল কোথায় ।বেশি খুঁজতে হল না । বুড়ো বেণীমাধব বহু বছর ধরে জমিদার বাড়ির মালি ।
সে আমাকে বলল যে বহুকাল আগে এই বাড়িতে এক পরিচারিকা ছিল ।তার একটা আট বছরের ফুটফুটে ছেলে ছিল । জমিদারবাড়ির বর্তমান মালিক লর্ড বীরেন্দ্র সিনহার বয়সী । পিঠোপিঠি দুই বালক একসঙ্গে বড় হচ্ছিল ।অনেকটা সময়ই একসঙ্গে কাটাত । কখনো মাছ ধরে, কখনো গাছে চড়ে ফল পেড়ে, কখনো বা ঘুড়ি নিয়ে সারাদিন মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে।তখনো প্রভু আর ভক্তের সম্পর্কের মত জটিল কিছু ছিল না । অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা যেমন জাত-শ্রেণী-বর্গের পার্থক্য না করে নিজেদের পছন্দমত বন্ধু খুঁজে নেয়, তেমনি স্বাভাবিক সরল বন্ধুত্ব ।
সেই ছেলেটি দিঘির জলে ডুবে মারা গিয়েছিল । পরিচারিকাটি তার শোকে পাগল হয়ে যায় ।ওই ছেলের আত্মা নাকি এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
অপঘাতে তো অনেকেই মরে ।কিন্তু অনেক সময় অনেক নির্মম-নিষ্ঠুর গল্প আমাদের মনে দানা বাঁধে ।হয়ত অবচেতন মনে আমরা সে দুর্ঘটনার সুব্যাখ্যা খুঁজতে থাকি । আমাদের চিন্তা যত গভীর হয় তত সেই দানা এক বিশাল বৃক্ষের রূপ নিয়ে আমাদের স্নায়ুর কোণে কোণে তার অস্তিত্ব বিস্তার করে । সয়নে-স্বপ্নে-জাগরণে আমরা সেই বৃক্ষের আন্দোলন অনুভব করি । অন্য কোন চিন্তায় সেই সুখ প্রাপ্তি হয় না । এক নিষ্পাপ শিশুর অপঘাতে মৃত্যুর কাহিনী হয়ত তেমনই তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে যে তার মৃত্যুর পরেও সাধারন মানুষ তাকে জীবিত দেখতে চায়। এবং সেই ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে পর এক ধরনের mass hallucination সৃষ্টি করে ।
গ্রামের লোক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না বুঝলেও বীরেন্দ্র বাবু আমার কথা অগ্রাহ্য করবেন না এবং তার প্রজাদের হিতের জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করবেন আশা করি । নৈশভোজের পর আমি তাকে সেই মন্ত্রণাই দিলাম ।
অনেক চিন্তার পর যখন উনি কথা বললেন তখন লর্ড সিনহার কণ্ঠস্বর স্থির । ঠান্ডা ইস্পাতের মত কঠিন ।
‘আমার মা মানসিক রোগী ছিলেন । বাবাকে নানা কারণে সন্দেহ করতেন । কখনো বলতেন যে আমি তার ছেলে নই । কখনো পরিচালিকার ছেলেটি বাবার অবৈধ সন্তান বলে দাবি করতেন । মা দিনে দিনে অসুস্থ হতে থাকলে বাবা আমাকে পড়াশোনার জন্য দার্জিলিং-এ বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন ।
কিছুদিন পর ছুটিতে বাড়ি এসে খবর পাই যে আমার বন্ধু জলে ডুবে মারা গেছে । কানাঘুষো শুনতে পাই যে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার মা । আমার অনুপস্থিতিতে বাবা কিছুটা নিজের ছেলের মতই তাকে দেখতে লেগেছিলেন । তার পড়াশোনা যাতে ভালোভাবে হয় তার জন্য মুন্সিজির কাছে বলা ছিল যে স্কুলের খাতাপত্র এবং যাবতীয় খরচ যেন তহবিল থেকে দেওয়া হয় । তার জন্য বাবার অনুমতি চাই না ।
সেটা শুনে আমার মার বিকৃত মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় জানি না । তবে কিছুদিন পর তাকে দিঘির পারে দেখতে পেয়ে মা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আলিঙ্গন করে জলের তলায় নিয়ে যান । ছেলেটির মৃতদেহ উদ্ধার হলেও মাকে আর পাওয়া যায়নি । মাকে আমি অনেক আগেই হারিয়ে ছিলাম কিন্তু বন্ধুকে হারিয়ে আরো বিহ্বল হয়ে পড়লাম । তার অভাগা মায়ের আর্তনাদ এখনো এই বাড়িতে শোনা যায় ।’
শুনে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল । সত্যি সত্যি যেন কোন মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম । আর বাইরে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা ছেলে হাতে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে ।
1 comment:
খুব সুন্দর, ভালো লেখা! একটা মহিলার version লিখিত!
Post a Comment