Copyright

Protected by Copyscape Duplicate Content Software You will copy with risks to penalties and criminal procedures.

Monday, April 30, 2018

অতিথি

কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প যদি বাংলায় লেখা হত তাহলে তা কেমন লাগত? অবশ্যই ট্রানসিলভানিয়ার কাউন্ট তখন হয়ে যেতেন বাংলাদেশের কোন বনেদি জমিদার বংশের বংশধর । আর জনাথন হারকার হয়ে যেতেন কোন ছাপোষা নেহাতই ভালোমানুষ বাঙালি ভদ্রলোক । 

ধারাবাহিকভাবে লেখার চেষ্টা করছি একটা অনুপ্রাণিত গল্প । তার প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় আমার ব্লগে প্রকাশ করলাম । ভালো লাগলে মন্তব্য করবেন

প্রথম অধ্যায়
হাওড়া ছেড়ে তখন রেলগাড়ি শিবনারায়ণপুর স্টেশনে পৌঁছেছে । আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা টাঙ্গা খুঁজছি । স্টেশন মাস্টার খুব সুহৃদ ব্যক্তি । বললেন, ‘এই সময় তো টাঙ্গা পাওয়া মুশকিল । আপনি বরং আমার অফিস ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন।’ আমি ধন্যবাদ জানিয়ে উনাকে বললাম যে আমি ওয়েটিং রুমেই ভালো সময় কাটাতে পারব । শুধু শুধু উনাকে বিব্রত করা উচিত মনে করলাম না ।

ওয়েটিং রুমের দিকে তখন সবে পা বাড়িয়েছি, উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’ আমি বললাম ‘জমিদার দেবনারায়ণ বাবুর বাড়িতে ।’সেটা শুনে একটা গ্রাম্য গোছের বয়স্ক মহিলা জোরে জোরে হরি নাম জপতে লাগলেন। আমার ব্যাপারটা এতই অদ্ভুত লাগলো যে আমি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম । স্টেশনমাস্টার আমতা আমতা করে আমাকে বললেন, ‘বয়স্ক লোকদের অনেক কুসংস্কার থাকে, আপনি কিছু মনে করবেন না । ওই বাড়ির খুব বদনাম আছে । অনেকেই তাই জমিদার বাড়ির নাম শুনলে ভয় পেয়ে যায়।’

বয়স্ক স্ত্রীলোকটি কিন্তু কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা উঠে এসে আমার হাত ধরে ফেললেন । কাকুতি মিনতি করে বলতে লাগলেন যে, ‘খোকা, এত কম বয়সে বেঘোরে প্রাণটা কেন দিতে চাও? আমাদের তো যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই কিন্তু তুমি শহর ছেড়ে এই পাড়াগাঁয়ে কেন মরতে এসেছ?’

বার্ধক্য জনিত ভীমরতি ভেবে আমার তার প্রতি খুব দয়া হল, তাই আমি উনাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারলাম না । আমার ঠাকুমাও শেষ বয়সে নানা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেন আর সন্ধ্যা হতে না হতেই কোন শব্দ শুনলে চেঁচিয়ে বলতেন, ‘কে যায়? কে যায় ওখানে?’ প্রথম কয়েক বার অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন কাউকে পাওয়া গেল না তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে ঠাকুরমার হয়ত স্মৃতি বিভ্রম হচ্ছে এবং শ্রাবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত হ্যালুসিনেশন হচ্ছে । যখন শব্দ হচ্ছে না উনি শুনতে পাচ্ছেন আর যখন সত্যিকারের শব্দ হচ্ছে উনি সেটা শুনতে পারছেন না । এই বৃদ্ধা হয়ত সমস্ত নব আগন্তুককে সাবধান বাণী শুনিয়ে তার কর্তব্য পালন করেন ।সত্যি বলতে কি পথে-ঘাটে তো বিপদের অভাব নেই । বেঘোরে প্রাণ যাওয়াটা আজকাল কিছুই অস্বাভাবিক নয় ।

বৃদ্ধাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যখন লোকজন উঠে পড়ে লেগেছে তখন তিনি নিজের হাতের রুদ্রাক্ষের মালাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বাছা । দুধের বাছা আমার । আহা! কি সুন্দর মুখখানি! যেন রাজপুত্তুর! ’

লজ্জায় আমার মুখ তখন লাল হয়ে গেল ।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্টেশন মাস্টার এসে বললেন যে জমিদার বাড়ি থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসেছে । সন্ধ্যা তখন ঘনীভূত । বাইরে পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না । দূরের আমবাগানের গাছগুলো অতীন্দ্রিয় প্রহরীর মত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । যেন কিসের অপেক্ষায় । এখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয় । বিজলি বাতি আসে নি । রাস্তাঘাট অন্ধকার । প্রকৃতির প্রভাবই বেশি । ফলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেসব অলীক ভয় কল্পনা করে জীবন রক্ষা করতেন সেসব কল্পনা এখানে এখনো জীবিত আছে ।


দ্বিতীয় অধ্যায়
পাড়াগাঁ দেখে হয়ত আমি ভেবেছিলাম যে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব । কিন্তু ঘোড়ার গাড়ির দুলুনিতে আর সারাদিনের পরিশ্রমের পর আমার ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল । কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আমি আধা শোয়া আধা বসা অবস্থায় চলতে লাগলাম । পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্ত পথিকের চোখের ঘুম আমার দুচোখে নেমে আসতে লাগল । কতক্ষণ এমন তন্দ্রার মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি জানি না । হঠাৎ মনে হল যেন আমরা সমতল ভূমি ছেড়ে একটা পাহাড়ী রাস্তায় উঠে পড়েছি । দেখে মনে হল না যে আমি বাংলায় আছি । কোথাও কোন সবুজের চিহ্ন নেই, কোন প্রাণের লেশমাত্র নেই । ঝিঁঝির ক্রন্দন নেই, পাখির ডাক নেই । বিধাতা যেন এই জায়গাটি গড়ে ভুলে গেছেন যে এতে প্রাণের সঞ্চারও করতে হবে । পৃথিবীর সমস্ত জীবিত উদ্ভিদ ও প্রাণীর চলাচল এই প্রাণহীন ব্যূহের বাইরে । প্রতিদিন যেন এই সীমান্তে জীবন ও মৃত্যুর যুদ্ধে জীবন পরাজিত হয় আর মৃত্যু তার রাজত্ব চালিয়ে যায় নির্বিরোধে । 

চারিদিকে চেয়ে দেখলাম অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না । অনতিদূরে একটা নীল আভা দেখতে পেলাম ।এই অলৌকিক মায়াপুরে সেটা কিছুই অসম্ভব বোধ হলো না । কোন ধাতুর আতিশয্যে, কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এই আলেয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভেবে নিদ্রার মধ্যেই যেন নিজেকে সান্তনা দিলাম । অকস্মাৎ অনুভব করলাম যে আমার নির্বাক সারথি একটা প্রাঙ্গণের মধ্যে তার সওয়ারি দাঁড় করিয়েছে । এমন এক ধ্বংসস্তূপের সামনে উপস্থিত হলাম যার কোন জানলার কোন কোণে একটা ছিটে ফোটা আলোর আভাস নেই । গাড়ি থেকে নামার সময় যখন গাড়োয়ান তার হাত বাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করতে লাগলো তখন তার গায়ের জোর অনুভব করে আশ্চর্য হলাম । লোকটা নিতান্ত প্যাকাটি মার্কা কিন্তু তার মুষ্টি ইস্পাতের মত শক্ত আর শিথিল । তার দেহের উষ্ণতাও যেন অনুপস্থিত । সেই শীতল স্পর্শে যখন আমার ঘুম কেটে গেছে তখন দেখলাম যে সদর দরজায় এক অতি বৃদ্ধ ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আছেন । তার হাতে একটা মোমবাতির শিখা লিকলিক করছে ; যেন সেই শিখা বন্দি হয়ে প্রাণপণে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে আর যে কোন মুহূর্তেই তার অবশিষ্ট প্রাণবায়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে । ভদ্রলোক তাঁর অদ্ভুত বাচনভঙ্গিতে আমাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আসুন! আসুন! নিজের ইচ্ছায় প্রবেশ করুন ! ’

এমন অদ্ভুত সম্ভাষণ শুনে আমার মনে হল যে উনি কোন ভৃত্যশ্রেণীর লোক নন । আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেবনারায়ণ বাবু কি আপনি ?’

উনি, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ!’ বলে মাথা নাড়তে নাড়তে ব্যস্ত হয়ে হাতের মোমবাতিটা একটা টেবিলের ওপর রেখে আমার সুটকেস খানা বগলদাবা করলেন । আমি অপ্রস্তুত হয়ে নিষেধ করলেও তিনি আমার কথা গ্রাহ্য করলেন না । বললেন, ‘আপনি ভ্রমণ করে অনেক পরিশ্রান্ত হয়েছেন হবে । হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম করুন । আমার চাকর বাকরেরা কেউ এত রাত্রে এখানে থাকে না, তাই আমিই সমস্ত ব্যবস্থা করেছি   আশা করি আপনার ভালো লাগবে ।’

আমার খিদে পেয়েছিল ভীষণ, কাজেই অগত্যা বিনা বাক্য ব্যয়ে নিমন্ত্রণকর্তার আদেশ পালন করলাম ।

সেই রাতে আমার ভালো ঘুম হলো না । বারে বারে রাস্তায় দেখা সেই নীল আভা আর সে বৃদ্ধার মুখ মনে পড়ে যেতে লাগলো ।‘কেন এসেছ? কেন? কেন?’

সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেকটাই দেরী হয়ে গেল । হাতমুখ ধুয়ে, তৈরি হয়ে খাবার ঘরে যখন উপস্থিত হলাম তখন সকাল দশটা বাজে । খাবার টেবিলের উপর একটা চিঠি রাখা ছিল তাতে মুক্তার মতো হাতের লেখায় লেখা ছিল যে, ‘ অকস্মাৎ আমার একটু কাজ পড়েছে । আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না । আশা করি প্রাতরাশ ভালো লাগবে’ - ইতি দেবনারায়ণ 

রুপোর রেকাবিতে দেখলাম লুচি-তরকারি মিহিদানা সাজানো আছে ।টি-পটে চা রাখা সঙ্গে আছে ফল আর দই । খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম কোন চাকর-বাকর এসে বাসন-কোসন গুলো নিয়ে যায় কিনা । কেউ যখন এলো না তখন চারদিক ভাল করে চেয়ে দেখলাম । এত ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য আমি আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । উকালতির কাজে অনেক বড় বড় লোকের বাড়িতে গিয়ে আমি থেকেছি কিন্তু এখানে আসবাবপত্রে যত সুন্দর কাজ করা আর যে পরিমাণ সোনায় মোড়া সেরকম মনে হয় না আর কোথাও দেখেছি । 

১৭ বা ১৮শ  খ্রিস্টাব্দের বারোক শৈলীতে নির্মিত ও অলঙ্কৃত এত সব জিনিস একসঙ্গে আমি শুধু ছবিতেই
 দেখেছি । বোঝাই যাচ্ছে যে এটা পুরনো টাকা । এরা ভুঁইফোড় নবাব নন । পয়সা আছে, রুচি আছে, সঙ্গে কিছুটা ছিট আছে । আসা অবধি একটা জন মনুষ্যের চিহ্ন দেখলাম না অথচ অর্থের অভাব আছে বলে তো মনে হয় না । এত বড় প্রাসাদপ্রমাণ বাড়িকে সামলে রাখার জন্যও তো অনেক লোকের প্রয়োজন ! তারা সবাই কোথায় ?

অনেক ঘুরেও যখন কারোর দেখা পেলাম না তখন একটা ছোট্ট লাইব্রেরীতে বসে আমি কিছুক্ষণ সময় কাটাবো ভাবলাম । লাইব্রেরীর দেয়ালে অনেক তৈলচিত্র আঁকা ছিল । তার মধ্যে একজন সুপুরুষ ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে আমার পিতামহের চেহারার অদ্ভুত মিল পেলাম । কাকতালীয় ব্যাপার ভেবে কথাটা বেশি গুরুত্ব দিলাম না । হয়ত আগের দিনের মানুষদের বেশভূষা একরকম ছিল বলে তাদের চেহারার মধ্যে সাদৃশ্য কল্পনা করছিলাম । কিন্তু সাদৃশ্য শুধু পরিধেয় বসনে নয় । চোখের চাহনি, গালপাট্টা, এমন কি নাক খানাও যেন অবিকল এক । কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে যেন ঘোর লেগে গেল । মাটির গুণেই হক বা এত খাওয়া দাওয়া করেই হোক এখানে আসার পর থেকে আমার কেবলই ঘুম পাচ্ছে । জাগ্রত অবস্থাতেও সম্পূর্ণ সচেতন বোধ করছি না । কোথায় এসে পড়েছি কে জানে? তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব এই নিশ্চয় করলাম । কিন্তু বাড়ির কর্তার অনুপস্থিতি আমার কাজের কোন সুবিধা করছে না । উনি যে সকাল থেকে সন্ধ্যে কোথায় থাকেন এবং সূর্যাস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার কোথায় হতে উদয় হন সেই রহস্য আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে । এই রহস্যের সমাধান একদিন করবো এটা মনে মনে স্থির করলাম ।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না । একদিন রাতের খাওয়া দাওয়ার পর দেবনারায়ণ যখন আমার থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি তার পিছন পিছন অনেকটা দূর গেলাম । এতদিন এখানে থেকেও সমস্ত ঘর আমার দেখা হয়নি ।বেশির ভাগ ঘরের দরজায় তালা লাগানো। একটা গলি পার হয়ে যখন উনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন তখন আমি একটা বড় জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলাম । সেদিন পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় যা দেখলাম তা কোনদিন ভুলবো বলে মনে করি না । এই জীবনে তো অবশ্যই না । তবে এই জীবনটা কতটুকু বাকি সেই সন্দেহও আমার মনে উঁকি দিতে লেগেছে । যত দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে যেন আমি এই প্রাসাদে একমাত্র জীবন্ত বন্দী । অনেক বছর ধরে এই বন্দীঘর ক্ষুধায় ছটফট করছিল আর তার কর্তা দূত পাঠিয়ে বলির পশু অর্থাৎ আমাকে আহ্বান করে এনেছে । মাকে বোধহয় আর দেখতে পাব না । মাঝে মাঝে মার মুখখানাও আবছা হয়ে পড়ছে । আমি যে শ্রীযুক্ত আদিত্য রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার, সেটা ভুলে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন আমি চিরকাল এই মৃত্যুপুরীর সাম্রাজ্যে বাস করে এসেছি । এখানে জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আছে শুধু অনন্তকালের অপেক্ষা আর হাহাকার । নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ অস্তিত্ব । এই অস্তিত্ব অর্থহীন । এতে সুখ নেই, দুঃখ নেই । ভালোবাসা নেই, ঘৃণা নেই । আছে শুধু অযত্ন আর ঔদাসীন্য ।

(ক্রমশ)

1 comment:

Suryatapa said...

Great work on translocating to a Bengali setting! Can't wait to read more... :-)